কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় যে গদ্যকার হিসেবেও কতখানি সফল ছিলেন তা বোঝা যায় তাঁর রিপোর্টাজধর্মী রচনাগুলি পাঠ করলে। বাংলা গদ্যসাহিত্যের ইতিহাসে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক লিখনশৈলীর পরিচয় পাওয়া যায় এখানে। রচনাগুলি একইসঙ্গে অত্যন্ত সহজ, সাবলীল ও সুখপাঠ্য। অথচ তাঁর কবিতাকেন্দ্রিক সমালোচনার ধারায় যে ব্যাপ্তি লক্ষ করা যায়, গদ্যসাহিত্যের ক্ষেত্রে অনুরূপ চর্চার সংখ্যা নগণ্য। তাই লেখকের রিপোর্টাজগুলিকে কেন্দ্র করে একটি সামগ্রিক পর্যালোচনার প্রয়োজনেই আলোচ্য প্রবন্ধের অবতারণা করা হয়েছে। ১৯৪২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে পার্টির বাংলা কমিটির মুখপত্র ‘জনযুদ্ধে’র রিপোর্টার হিসেবে নিযুক্ত হন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। পি সি যোশী বা পূরণচাঁদ যোশীর কাছে পাঠ নেন সাংবাদিকতার আর সোমনাথ লাহিড়ীর কাছে শেখেন গদ্যরচনার কলাকৌশল। এই সময়েই পত্রিকার ‘ইনভেস্টিগেটিং রিপোর্টিং’ এর কাজে গ্রাম বাংলার সফর শুরু হয় তাঁর। মূলত পত্রিকার কমিটেড পাঠকের জন্য প্রতিবেদন লেখা শুরু করেন। কিন্তু লেখকের কবিমানস লেখাগুলিকে কেবল কেজো ‘রিপোর্টিং’ হিসেবে সীমাবদ্ধ রেখে সেগুলিকে করে তোলে ‘রিপোর্টাজ’। বিবিধ সাহিত্যিক উপাদানের সংযোগে প্রাণপ্রাচুর্যে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে লেখাগুলি। বন্ধুবর দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের প্রণোদনায় লেখাগুলি কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে প্রকাশিত হয় মাসিক ‘রংমশাল’ পত্রিকায়। এই লেখাগুলিই একত্রে সংকলিত হয়ে ১৯৫১ সালে ‘আমার বাংলা’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়। লেখকের ‘রিপোর্টাজ’ধর্মী লেখার এটিই প্রথম সংকলন। এরপর প্রায় চার দশক ধরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার পাতায় রিপোর্টাজ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত লেখকের এরূপ ছ’টি রিপোর্টাজধর্মী গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে: ‘আমার বাংলা’ (১৯৫১), ‘যখন যেখানে’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৭), ‘ডাকবাংলার ডায়েরি’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭২), ‘নারদের ডায়েরি’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৬), ‘ক্ষমা নেই’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৮), ‘আবার ডাকবাংলার ডাকে’ (১৯৮১)। ‘রিপোর্টিং’ নির্দিষ্ট গতে বাঁধা বিন্যাসে বিন্যস্ত; অন্যদিকে ‘রিপোর্টাজ’ সংরূপগতভাবে অনেকাংশে স্বাধীন প্রকাশমাধ্যম; ন্যারেটিভের বহুমাত্রিক শিল্পকুশলতাকে প্রকাশ করতে তা সক্ষম। সেজন্যই এই রচনাগুলিতে কখনো খুঁজে পাওয়া যায় ছোটগল্পের গঠনবিন্যাস, কখনো বা ফুটে ওঠে রম্যরচনার আবহ। সাহিত্যিক উপাদান হিসেবে লেখাগুলিতে ব্যবহৃত হয়েছে বাংলার চিরায়ত লোকগান রূপকথা ব্রতছড়ার স্বর ও সুর, প্রান্তিক মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আকার পেয়েছে লেখকের কলমে। এককথায় ‘রিপোর্টাজ’ নির্মিত হয়েছে এক স্বতন্ত্র ফর্মে।